রঙিন বাস, ফিকে বাস্তবতা: সমাধান কী?

0
HASNAT NAYEM; DP-243

সকাল ১১টা। রাজধানীর ব্যস্ত ডিআইটি রোডের রামপুরায় বেটার লাইফ হাসপাতালের সামনে একের পর এক থামছে গোলাপি রঙের বাস। ১৫ মিনিটের মধ্যে ১৫টির বেশি বাস রামপুরা থেকে মালিবাগের দিকে পয়েন্টটি অতিক্রম করল। ভিক্টর ক্লাসিক ও আকাশ পরিবহনের এসব বাস রঙে যতটা আকর্ষণীয়, বাস্তবতায় ঠিক ততটাই ভঙ্গুর।

বাস দুটি একক কোম্পানির অধীনে পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও আদতে তা হচ্ছে না। গোলাপি বাসের উদ্দেশ্য ছিল— নগর পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।

সোমবার (৭ জুলাই) সরেজমিনে দেখা যায়, এসব বাসে যাত্রী ওঠানামার জন্য নির্দিষ্ট কোনো কাউন্টার নেই। সিটিং সার্ভিসের নাম থাকলেও বাস্তবে যাত্রীরা গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকে আবার ঝুলছেন বাসের দরজার হ্যান্ডেল ধরে। তারপরও থামছে না কন্ডাক্টরের হাঁকডাক।

বাসগুলোর বাহ্যিক চেহারা আরও হতাশাজনক। মাত্র পাঁচ মাস আগে গোলাপি রঙে রাঙানো বাসগুলো এখনই ফিকে হয়ে গেছে। মানহীন রঙের প্রলেপ বাসের সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারেনি। কোনো কোনো বাসে রয়েছে শতাধিক ঘর্ষণের দাগ। কোনোটার জানালার কাচ ভাঙা, আবার কোনো বাসের পেছনের নির্দেশক বাতিগুলো নেই। এর বাইরে, এক বাসের সঙ্গে আরেক বাসের চলছে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। কে আগে যাত্রী তুলবে, কে আগে স্টপেজ ছাড়বে। এতে যাত্রী সেবার বদলে ঝুঁকি আর বিশৃঙ্খলাই যেন বাড়ছে।

‘একক কোম্পানি’ চালুর লক্ষ্য ছিল শৃঙ্খলা ফেরানো

গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা দূর করতে রুট রেশনালাইজেশন (বিচ্ছিন্ন গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ঐক্যবদ্ধ কর্তৃপক্ষের অধীন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া) আটকে রেখে একক কোম্পানি ব্যবস্থার ধারণা আনা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়। উদ্দেশ্য ছিল— নির্ধারিত রুটে বাস চলবে, যাত্রীদের কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে হবে, ই-টিকিটিং চালু হবে, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া বাস দাঁড়াবে না এবং অতিরিক্ত যাত্রী বা দাঁড়িয়ে যাতায়াত পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকবে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, কে শোনে কার কথা! পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেমন করে হারিয়ে গিয়েছিল নগর পরিবহনের সেবা, তেমনি গত পাঁচ মাসে হারিয়ে গেছে এই গোলাপি বাসের শৃঙ্খলা।

যাত্রীরা বলছেন, পরিবহন ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করেছে। যত পরিকল্পনাই নেওয়া হোক, শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। ভাড়া বাড়ে, যাত্রী বাড়ে, কিন্তু সেবার মান বাড়ে না।

ভিক্টর ক্লাসিকের যাত্রী আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভাড়া নিচ্ছে বেশি, কিন্তু সেবা আগের মতোই খারাপ। কাউন্টার বলে কিছু নেই। বাসে উঠলেই দেখা যায় ঠাসাঠাসি, ভিড়। গা ঘষাঘষি করে থাকতে হয়।’

আকাশ পরিবহনের যাত্রী সঞ্জয় সরকার বলেন, ‘যখন নতুন রঙের বাস শুরু হলো, তখন ভেবেছিলাম কিছু উন্নতি হবে। কিন্তু এখন দেখি আগের চেয়েও খারাপ। একসঙ্গে তিনটা বাস এসে দাঁড়ায়। কে কার আগে যাবে, সেটা নিয়েই এক বাস আরেক বাসকে চাপ দেয়। রাস্তা বন্ধ করে রাখে। এগুলো কেউ দেখে না।’

চুক্তিতে চালালেই মুনাফা বেশি

বাসশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চুক্তিভিত্তিক বাস চালানোই তাদের বেশি লাভজনক মনে হয়। কারণ, চুক্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা মালিককে দেওয়ার পর বাকি যা থাকে তা চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। আকাশ পরিবহনের এক কন্ডাক্টর বলেন, ‘কাউন্টার হলে তো সব টাকাই মালিক নিয়ে যায়। আমাদের কিছুই থাকে না। কিন্তু চুক্তিতে চালালে আমাদের অতিরিক্ত কিছু টাকা থাকে।’

জাঁকজমক উদ্বোধন, ফলাফল শূন্য

চলতি বছরের শুরুর দিকে অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী গোলাপি বাস সার্ভিসের উদ্বোধন করেন। ওইদিন থেকে ২১টি কোম্পানির দুই হাজার ৬১০টি বাস একক কোম্পানির আওতায় পরিচালনার জন্য গোলাপি রঙে রাস্তায় নামানো হয়।

ওই বাসমালিকদের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম তখন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গত ১৬ বছর ধরে ঢাকা শহরে বাস-মিনিবাস চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করছে। এতে গাড়ি চলাচলে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করার কারণে সড়কে যানজট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে এবং দুর্ঘটনাও ঘটছে।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছে, গাড়ির মালিকদের চালকদের সঙ্গে ট্রিপভিত্তিক চুক্তি না করে পাক্ষিক বা মাসিকভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। চলতি মাসের (ফেব্রুয়ারি) মধ্যে মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুরে চলাচল করা বাসগুলো টিকিট কাউন্টারের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে।’

‘এখন থেকে বাস কাউন্টার পদ্ধতিতে চালাতে হবে এবং যাত্রীদের নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া বাস দাঁড় করানো যাবে না এবং যাত্রী ওঠানো যাবে না। টিকিট কাউন্টারভিত্তিতে গাড়ি পরিচালনায় বাসচালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে’— বলেও তখন জানান সমিতির সাধারণ সম্পাদক।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এত কথার পরও বাস্তবতায় এসবের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।

আমি লজ্জিত: পরিবহন মালিক সমিতির নেতা

গত ৭ জুলাই সন্ধ্যায় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম ঢাকা পোস্টের কাছে আক্ষেপ করে বলেন, ‘পরিবহনের বেহাল অবস্থা নিয়ে আমি লজ্জিত। গোলাপি পরিবহন ঠিক মতো চলছে না। দীর্ঘদিনের অনিয়ম ভেঙে কম লাভের জায়গায় কেউ যেতে চায় না।’

‘আমি বলতে চাই, যারা কোম্পানি চালাবে তাদের জন্য সম্মানী থাকতে পারে। কিন্তু অধিক লাভ করাটা ঠিক না। আমরা সিটি কর্পোরেশনকে স্টপেজের জায়গা দেওয়ার কথা অনেকবার বলেছি। উপদেষ্টা নিজে নির্দেশ দিয়েছেন। তারা জায়গাটা দিলে আমরা নিজেরাই সব ব্যবস্থা করব।’

“কিন্তু সেটা তারা দিচ্ছে না। একটা জায়গায় কাউন্টার বসাতে গেলে পাশের দোকানের মালিক বলেন, ‘এখানে বসানো যাবে না’। হকাররা বলেন, ‘এটা আমার জায়গা’। আমরা সবকিছু গোছানোর চেষ্টা করছি। খুব দ্রুতই একটা ফল আপনাদের দিতে পারব।”

কোনো কিছুই চেঞ্জ হয়নি, শুধু বাসের কালার ছাড়া: পরিবহন বিশেষজ্ঞ

গণপরিবহনের বেহাল দশা প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটা সুন্দর পরিবহন ব্যবস্থার জন্য আমরা সবসময় পরামর্শ দিয়েছি, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষও (ডিটিসিএ) শুরু করেছিল— বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি করে ফেলতে হবে। এত মালিক, এত কোম্পানি থাকা যাবে না। সবাইকে একটা নির্দিষ্ট রুটের আওতায় নিয়ে এসে বাস পরিচালনা করতে হবে।’

‘কিছুদিন আগেও ডিটিসিএ রুট রেশনালাইজেশনের কাজ চলমান রেখেছিল। কিন্তু এটি নষ্ট করার জন্যই গোলাপি কালারের বাসের কনসেপ্ট নিয়ে আসা হয়েছে। আলটিমেটলি কিছুই হলো না। এখন একই রুটে গোলাপি কালারের বাস চলে, অন্য বাসও চলে। কোনো কিছুই চেঞ্জ হয়নি, শুধু বাসের কালার চেঞ্জ হয়েছে।’

অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ঢাকা পোস্টে’ প্রকাশিত আরও ছবিসহ মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *