বৃষ্টিতে বাড়ছে ডেঙ্গুর ঝুঁকি, সমাধান কোথায়?

0
HASNAT NAYEM; DP-250

ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। সামনে টানা বৃষ্টি হলে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের সেই আভাস যেন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। চলতি বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড গড়েছে গত ২১ সেপ্টেম্বর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে এদিন ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনই মারা গেছে বরিশাল বিভাগে। এ নিয়ে এডিস মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১৭৯ জনে। আর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৪১ হাজার ৮৩১ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে ১২ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে এর মধ্যে নয়জনের মৃত্যু হয়েছে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায়। অর্থাৎ, ২০ সেপ্টেম্বর সকাল আটটা থেকে ২১ সেপ্টেম্বর সকাল আটটা পর্যন্ত। বাকি তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এর আগের ২৪ ঘণ্টায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৭৪০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৪৪ জন পুরুষ এবং ২৯৬ জন নারী। একই সময়ে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৬৮৩ জন রোগী।

বিভাগভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, এই ১২ জনের মধ্যে বরিশাল বিভাগে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়। বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন জন ও দুজন বরগুনায় মারা গেছে। বাকি সাতজনের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির হাসপাতালগুলোতে তিনজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় দুজন এবং চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে একজন করে মারা গেছে। সর্বশেষ মৃত্যুর তালিকায় শিশু থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

চলতি বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বোচ্চ ছিল, তবে একদিনে এত বেশি মৃত্যুর নজির এই বছর প্রথম। সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখ ডেঙ্গুতে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২১ সেপ্টেম্বরের আগে এটিই ছিল একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সভিত্তিক রোগী ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টানা বৃষ্টির কারণে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে আছে, যা এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছে। ফেলে রাখা টব, ড্রাম, নির্মাণাধীন ভবন এবং অলিগলিতে মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টির তিন থেকে পাঁচ দিন পর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। বর্ষার বাড়তি আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা মশার বংশবৃদ্ধি আরও বাড়িয়ে তোলে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।

এদিকে, গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীতে কম-বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৭ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হতে পারে।

বাসায় মশা দেখলে ভয়ে থাকি, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চিন্তা হয়

ঢাকার খিলগাঁও, রামপুরা, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় উন্মুক্ত ড্রেন ও নালায় পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এসব স্থানে প্লাস্টিক, পলিথিন, খাবারের বর্জ্য ও ময়লা জমে পানি স্থির হয়ে আছে, যা মশার প্রজননের জন্য সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।

খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা কাজী মাহবুব বলেন, প্রতিদিনই ডেঙ্গুর খবর দেখে আতঙ্কিত হই। কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, কতজন মারা যাচ্ছে! আর বাসায় মশা দেখলে ভয়ে থাকি। কয়েল জ্বালালেও শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। পরিবারে আরও সদস্য আছে, সবাইকে নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয়। আবহাওয়ার অবনতি, বৃষ্টি তো হবেই। এগুলোকে মাথায় রেখে সরকারকে নগরবাসীর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

রামপুরার বাসিন্দা শফিক আহমেদ বলেন, চারিদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখে সত্যিই খুব ভয় লাগছে। আমার বাসার আশপাশে অনেক নোংরা ড্রেন আর তাতে আবর্জনা জমে আছে। ফলে মশার উপদ্রব দিনদিন বাড়ছে। সিটি কর্পোরেশনকে নিয়মিত মশা মারার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না। আমরা নিজেরা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু চারপাশের পরিবেশ ভালো না হলে শুধু আমাদের চেষ্টায় তো কিছু হবে না। সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে আমরা ডেঙ্গুর ভয় থেকে দ্রুত মুক্তি পাই।

ডেঙ্গু নিয়ে বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি ডা. আবু জামিল ফয়সাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার শুধু বেশি নয়, বরং প্রচণ্ড মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি সরকার স্বীকার করুক বা না করুক, প্রতিদিনই সরকারি হাসপাতালে ২০০ থেকে ২৫০ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এটি কেবল সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের হিসাব। বেসরকারি ছোট-বড় হাসপাতালগুলোতেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জরুরি

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জরুরি নির্দেশনা জারি করলেও ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় মশার বংশবিস্তারের স্থান এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ দমন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু এখন শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালের মহামারির পর এই ভাইরাস দেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।

‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছরের শুরুতেই সতর্ক করেছিল যে কিছু এলাকায় ডেঙ্গু মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি। ফলে সংক্রমণের প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা আগেই ছিল।’

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত এবং বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। এই কাজটি সারাদেশে একযোগে পরিচালনা করে এতে সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবকদের যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, প্রয়োজনে উড়ন্ত মশা ও লার্ভা দমনের জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, জলাবদ্ধতার সঙ্গে কিউলেক্স মশার বিস্তারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। জলাবদ্ধ স্থানেই এ মশার জন্ম হয়। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জরুরি। পারস্পরিক সমন্বয় ছাড়া কিউলেক্স মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে একযোগে কাজ করলেই এ সমস্যার কার্যকর সমাধান পাওয়া যাবে।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ঢাকা পোস্ট’-এ প্রকাশিত আরও ছবিসহ মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *