ক্রু সংকটে আটকে গেল পদ্মা রেল সংযোগের পুরো রুটের উদ্বোধন

0
HASNAT NAYEM; DP-223

কথা ছিল আজ (২ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় খুলনা থেকে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও ঢাকা থেকে বেলা ১১টায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পুরো রুটে হুইসেল বাজাবে। আর এরমধ্যে দিয়েই পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর-খুলনা-বেনাপোল সেকশনে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের দ্বার খুলবে। কিন্তু সেই কথার ছেদ পড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ না করার সিদ্ধান্তে।

বারবার আশ্বাসের পরও মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন দেওয়া এবং আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে জটিলতা নিরসন না হওয়ায় ১ ডিসেম্বর থেকে রেলওয়ের নিয়ম অনুযায়ী ট্রেন চালাচ্ছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। ফলে তারা ৮ ঘণ্টা ডিউটির পর হেড হেডকোয়ার্টারে ১২ ঘণ্টা ও রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে ১০ ঘণ্টা বিশ্রাম নিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এতে করে বিপাকে পড়েছে রেলওয়ে, চলছে না নির্ধারিত সময়ে ট্রেন। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। এই ঘটনায় গতকাল রোববার ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১০টি ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে এবং ঢাকা থেকে সিলেট, জয়দেবপুর ও দেওয়ানগঞ্জগামী মোট ৩টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। এমন ঘটনায়, আজও সারাদেশের ট্রেন যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, ২ হাজার ২৫০টি লোকোমোটিভ মাস্টার ও সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টার পদের মধ্যে মাত্র ৭৫০টি পদ পূর্ণ রয়েছে। ফলে নিয়ম অনুযায়ী বিশ্রাম না করে ৫/৬ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়েই ট্রেনের সময়সূচি ধরে রাখতেই আবার ট্রেন চালাতে হতো তাদের। কিন্তু তারা এখন এই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন না।

কী চাচ্ছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা

কর্মীরা বলছেন, আইন অনুযায়ী— হেডকোয়ার্টারে তাদের ৮ ঘণ্টার ডিউটি শেষে ১২ ঘণ্টা বিশ্রাম করার কথা। কিন্তু রেলওয়ের কর্মী সংকট থাকায় তারা ৫/৬ ঘণ্টা বিশ্রাম করার পর আবার কাজে নেমে যান। রেলের কর্মীরা রেলের স্বার্থে কাজ করতে চান। কিন্তু রেলওয়ে তাদের স্বার্থের বিষয়ে আন্তরিক নয়। এর প্রতিবাদে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নেমেছেন তারা।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী একজন রানিং স্টাফ (চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিকিট চেকার) ট্রেনে দায়িত্ব পালন শেষে তার নিয়োগপ্রাপ্ত এলাকায় (হেডকোয়ার্টার) হলে ১২ ঘণ্টা এবং এলাকার বাইরে (আউটার স্টেশন) হলে ৮ ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। রেলওয়ের স্বার্থে কোনো রানিং স্টাফকে তার বিশ্রামের সময়ে কাজে যুক্ত করলে বাড়তি ভাতা-সুবিধা দেওয়া হয়। যা রেলওয়েতে ‘মাইলেজ’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত।

২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় মাইলেজ সুবিধা সীমিত করতে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে আনলিমিটেড মাইলেজ সুবিধা বাদ দিয়ে তা সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবসের সমপরিমাণ করার কথা জানানো হয়। এছাড়া বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক ভাতায় মূল বেতনের সঙ্গে পাওয়া কোনো ভাতা যোগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রানিং স্টাফরা।

মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে গত ৩ বছর সময় ধরে আন্দোলন করছেন রানিং স্টাফরা। কয়েক দফায় অতিরিক্ত কাজ থেকে বিরত থাকা এবং ধর্মঘট পালন করেছেন তারা। তবে বিভিন্ন সময়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক, রেলপথ সচিব, রেলমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে আসেন তারা।

সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর এক সভায় রানিং স্টাফরা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকীকে জানান, বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং কর্মচারীরা সুদীর্ঘকাল থেকে রানিং অ্যালাউন্স এবং পেনশন ও আনুতোষিক হিসাবের ক্ষেত্রে রানিং অ্যালাউন্স যুক্ত হয়ে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা পেয়ে আসছেন। পরবর্তী সময়ে রেলওয়ের বিধি বিধান উপেক্ষা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর তারিখের প্রজ্ঞাপনে রানিং কর্মচারীদের রানিং অ্যালাউন্স আগের থেকে কমানো হয় এবং পেনশন ও আনুতোষিকের ক্ষেত্রে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে সুবিধা প্রদানে অসম্মতি জানানো হয়।

আরও জানানো হয়, এছাড়া ২০২২ সালে নতুন নিয়োগ পাওয়া এএলএম গ্রেড-২ ও গার্ড গ্রেড-২ রানিং কর্মচারীদের ক্ষেত্রে রানিং অ্যালাউন্স কমানো হয় এবং রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি এই সুবিধাদি না দেওয়া হয় ১ নভেম্বর থেকে রানিং স্টাফরা বিধি মোতাবেক দায়িত্ব পালন করবেন এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন না। এছাড়া ২০২২ সালে নতুন যোগদান করা রানিং স্টাফরা হেড কোয়ার্টারের বাইরে কোনো ডিউটি পালন করবেন না।

তখন সভায় রেলপথ সচিব আবদুল বাকী বলেন, তাদের এ দাবি দাওয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে অর্থ সচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এবং বিষয়টি উপদেষ্টা, রেলপথ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া আগামী ৩০ দিনের (৩০ নভেম্বর) মধ্যে এই সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে বলে জানানো হয়।

পরে রানিং স্টাফরা ৩০ দিনের জন্য তাদের আন্দোলন থেকে সরে আসেন। ৩০ দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় তারা গত ১ ডিসেম্বর থেকে বিধি মোতাবেক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন না। আর কর্মী সংকট থাকায় বিপাকে পড়েছে রেলওয়ে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা নতুন কোনো বিষয় নয়, এটা ১৬০ বছর ধরে চলে আসছে। ১৬০ বছর ধরে চলে আসা একটা নিয়ম হুট করে বন্ধ করে দেবে, এটা তো রেলের কোনো স্টাফ মেনে নিতে পারে না। আমরা ওনাদের বারবার সময় দিয়েছি, বারবার আন্দোলন করেছি, বারবার প্রত্যাহার করেছি। কিন্তু এবার আর কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলছি।

পদ্মা রেল সংযোগের পুরো রুটে কবে চলবে ট্রেন?

‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের’ পুরো ১৭২ কিলোমিটার রেলপথের কাজ শেষ, এখন শুধু উদ্বোধনের পালা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু এবং গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী হয়ে যশোর-খুলনা রেলপথে যাতায়াতের দূরত্বের সময় কমবে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার মতো এবং যশোর-বেনাপোল রেলপথে ৪ ঘণ্টার মতো। প্রতিটি সেকশনে পথ কমবে প্রায় অর্ধেকের বেশি। ফলে এই পথের এক এক জোড়া ট্রেনকে দুইবার চালানোর কথাও ভাবছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

গত বছরের ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে প্রথম বাণিজ্যিক আন্তঃনগর ট্রেন চালানো হয় ফরিদপুরের ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত। সে সময় পুরো প্রকল্পের ১৭২ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে উদ্বোধন করা হয় মাত্র ৮২ কিলোমিটার। ভাঙ্গা জংশন স্টেশন থেকে মুকসুদপুর, লোহাগড়া, নড়াইল হয়ে প্রকল্পের বাকি ৯০ কিলোমিটার রেলপথ ইতোমধ্যে প্রস্তুত। ফলে প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ রেলপথে আজ ২ ডিসেম্বর ট্রেন চালাতে চেয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। যদিও প্রকল্পটিতে লুপ লাইন ও সাইড লাইন রয়েছে ৪৩ দশমিক ২ কিলোমিটার। ফলে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য ২১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার।

প্রকল্পের দায়িত্বশীল সূত্রে আরও জানা যায়, বর্তমানে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, রাজাবাড়ী, চুয়াডাঙ্গা ও যশোর হয়ে খুলনার দূরত্ব ৪১২ কিলোমিটার। কিন্তু নড়াইল হয়ে যশোরের পদ্মবিলা জংশন রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রকল্পের রেলপথটি ১৭২ কিলোমিটার। ফলে এই পথে খুলনা যেতে দূরত্ব কমে দাঁড়াবে ২৪০ কিলোমিটার। যা সময়ের হিসেবে সাড়ে ৩ ঘণ্টা কম লাগবে। বর্তমান পথে ঢাকা থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ৪১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৭ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। প্রকল্পের রেলপথ দিয়ে ট্রেনটি ৪ ঘণ্টার মধ্যে খুলনা পৌঁছাতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে বর্তমান রুটে বেনাপোলগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের ৩৬৫ কিলোমিটার রেলপথ পাড়ি দিতেও সময় লাগে ৭ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। প্রকল্পের পথ দিয়ে যশোর হয়ে বেনাপোল যেতে ট্রেনটিকে পাড়ি দিতে হবে ১৯৩ কিলোমিটার পথ। ফলে এই পথে ট্রেনটির বেনাপোল যেতে সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা। সময় সাশ্রয় হবে ৪ ঘণ্টা।

প্রকল্পের রেলপথটি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতির ব্রডগেজ লাইন। যদিও ঢাকা থেকে পদ্মবিলা জংশন রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার পর প্রকল্পের একটি শাখা লাইন যশোরের রূপদিয়া এবং অন্য একটি শাখা লাইন খুলনার সিঙ্গিয়া স্টেশনে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে খুলনার ট্রেনগুলো পদ্মবিলা থেকে সিঙ্গিয়া হয়ে খুলনা স্টেশনে যাবে। যদিও পদ্মবিলা থেকে রূপদিয়া হয়ে যশোরের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার।

ঘোষণা দিয়েও কেন আজ পুরো রুটে যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক ট্রেন চালানো গেল না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের একটা ক্রাইসিস চলছে। মাইলেজ অ্যালাউন্সের জন্য রানিং স্টাফরা আন্দোলনে গেছে। তাদের আন্দোলনের জন্য আমাদের ট্রেন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। কিছু কিছু ট্রেন চলাচলে বিলম্ব হচ্ছে, কিছু কিছু ট্রেন বাতিল করা হচ্ছে। এটার সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পুরো রুটে ট্রেন চালাতে পারছি না। এটার জন্য দেনদরবার করা হচ্ছে। তবে অবশ্যই ডিসেম্বরের মধ্যে চালু হবে।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ঢাকা পোস্টে’ প্রকাশিত আরও ছবিসহ মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *