ট্রেনের কোটি টাকার ওয়াশিং প্ল্যান্ট : যেখানে হাত-ই শেষ সম্বল

0

সময় বাঁচিয়ে ট্রেন পরিষ্কারে গতি আনতে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে স্থাপন করা হয় দুটি ‘অটোমেটিক ট্রেন ওয়াশিং প্ল্যান্ট’। যার প্রতিটিতে ব্যয় হয় ১৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ‘মিটারগেজ ও ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় প্ল্যান্ট দুটি স্থাপনে মোট ব্যয় হয় ৩৬ কোটি টাকা।

মিটারগেজ লাইনের প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয় দেশের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুরে। ব্রডগেজ লাইনের প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয় রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে।

তবে, এত টাকা ব্যয় করেও নানা জটিলতায় ট্রেন পরিষ্কারে সময় বাঁচিয়ে গতি আনতে পারছে না প্ল্যান্ট দুটি। বেশিরভাগ সময় সেগুলো থাকছে অব্যবহৃত। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি একটি অপরিকল্পিত প্রকল্প। প্রকল্পের প্রতি রেলওয়ে বিভাগের যে অতি-আসক্তি, এটি তারই প্রতিচ্ছবি!

কমলাপুরে স্থাপিত অটোমেটিক ট্রেন ওয়াশিং প্ল্যান্টে ২৪ ঘণ্টায় ২০ থেকে ২২টি ট্রেন পরিষ্কার করা সম্ভব। তবে, পরিষ্কারের জন্য প্রতিদিন সিডিউলে থাকে প্রায় ২৬টি ট্রেন। এর মধ্যে ১৬টি আন্তঃনগর ও ১০টি মেইল ট্রেন। অন্যদিকে, ব্রিটিশ আইন দিয়ে পরিচালিত বাংলাদেশ রেলওয়েতে বলা আছে, ওয়াশ পিটে (ট্রেন পরিষ্কারের স্থান) প্রতিটি ট্রেনের জন্য বরাদ্দ সময় আড়াই ঘণ্টা।

নামে ওয়াশ পিট হলেও এখানে চলে নানা কাজ। রেলওয়ের ভাষায় যাকে বলে ‘সিডিউল মেরামত’। কাজগুলো হচ্ছে- ট্রেনের আউটসাইড ওয়াশ অ্যান্ড ক্লিনিং, ইনসাইড ওয়াশ অ্যান্ড ক্লিনিং, টয়লেট ওয়াশ ক্লিনিং অ্যান্ড ওয়াটারিং, আন্ডার গিয়ার মনিটরিং অ্যান্ড রিপেয়ার এবং ইন্টোরিয়র মনিটরিং অ্যান্ড রিপেয়ার। এসব কাজের জন্য প্রতিটি ট্রেনের বরাদ্দ সময় আড়াই ঘণ্টা। কিন্তু সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ট্রেনপ্রতি এক ঘণ্টাও সময় মিলছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অটোমেটিক এ ওয়াশিং প্ল্যান্ট দিয়ে দিনে সর্বোচ্চ সাত থেকে আটটি ট্রেনের শুধুমাত্র বাইরের অংশ (আউটসাইড) পরিষ্কার করা সম্ভব। বাকি কাজগুলো হয় ম্যানুয়ালি। যেখানে হাত-ই শেষ সম্বল!

সম্প্রতি কমলাপুর রেলস্টেশনে সরেজমিনে অটোমেটিক ট্রেন ওয়াশিং প্ল্যান্ট ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ট্রেন মেরামতের জন্য চারটি লাইন আছে। লাইনগুলোর মধ্যে ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যের লাইনে ১০টি, ১০১০ ফুট দৈর্ঘ্যের লাইনে ১৬টি, ১০২০ ফুট দৈর্ঘ্যের লাইনে ১৬টি এবং ১০৮০ ফুট দৈর্ঘ্যের লাইনে ১৮টি কোচ একসঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। তবে, সেগুলো হয় ম্যানুয়ালি। এর বাইরে আরেকটি লাইন রয়েছে। সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন পরিষ্কার করা যায়। শেড ঘুরে মনে হয়েছে, একটু আগে সেখানে ট্রেন পরিষ্কারের কাজ শেষ হয়েছে।

সেখানে কর্মরত এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ট্রেন পরিষ্কারের সবকিছু অটোমেটিক মেশিনে হয় না। মেশিনে ট্রেনের বাইরের অংশ হলকাভাবে পরিষ্কার করা যায়। বাকি কাজ আমাদের হাতেই সম্পন্ন করতে হয়। যাত্রীদের বমি, পানের পিক, চায়ের দাগ— এগুলো হাতে ঘষেই পরিষ্কার করতে হয়। ট্রেনের ভেতরে তো মেশিন যেতে পারে না।

প্ল্যান্টে যেভাবে ট্রেন ওয়াশ হয়

অটোমেটিক ট্রেন ওয়াশিং প্ল্যান্টের জন্য বড় একটি শেড রয়েছে। শেডের ভেতরে রয়েছে সেন্সর, পানি স্প্রে করার জন্য হাইস্পিড নজেল ও সাতটি ব্রাশ। এর বাইরে আরও একটি শেডে রয়েছে কন্ট্রোল প্যানেল। এখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় ওয়াশিং প্ল্যান্ট।

প্ল্যান্টের শেডের ভেতরে তিন কিলোমিটার গতিতে চালানো হয় ট্রেন। ট্রেন চলার সময় বিভিন্ন সেন্সর ট্রেনের সাইজ ও অবস্থান নির্ণয় করে। সেই অনুযায়ী পানির প্রবাহ ও ব্রাশ ঘুরিয়ে ট্রেনের বাইরের অংশ পরিষ্কার করা হয়।

সেন্সর প্রথমে ট্রেনের অবস্থান নির্ণয় করে। দুটি পাইপে থাকা বেশ কয়েকটি নজেল ডানে, বামে ও ওপর থেকে পানির ছিটায়। এতে ট্রেনটি পুরোপুরি পানিতে ভিজে যায়। দ্বিতীয় সেন্সরটি ট্রেনের উচ্চতা মেপে ট্রেনের ছাদ পরিষ্কারের জন্য থাকা ব্রাশ বারকে নির্দেশনা দেয়। সেই অনুপাতে ব্রাশ বারটি ঘুরতে থাকে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছাদ পরিষ্কার হয়ে যায়।

তৃতীয় সেন্সরের নির্দেশে ওপর থেকে বেশ কয়েকটি হাইস্পিড নজেল ঘুরে ঘুরে ছাদে পানি দিয়ে শেষবারের মতো পরিষ্কার করে। এরপর চতুর্থ সেন্সরটি ট্রেনের ডান ও বাম পাশ মেপে ব্রাশ চালায়। ফলে ট্রেনের দুই পাশে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার হয়ে যায়। পঞ্চম সেন্সরটি দুই পাশে থাকা বেশ কয়েকটি হাইস্পিড নজেল দিয়ে দুই দিক থেকে পানি ছিটায় এবং চূড়ান্ত পরিষ্কারের কাজটি সম্পন্ন হয়।

ষষ্ঠ সেন্সরটি ট্রেনের অবস্থান নির্ণয় করে এবং কয়েকটি হাইস্পিড নজেলের মাধ্যমে নিচ থেকে পানি ছিটিয়ে ট্রেনের নিচের অংশ পরিষ্কার করে। সপ্তম সেন্সরটি দুই পাশের বার এবং ওপরে থাকা মোট নয়টি হাই স্পিড ব্লোয়ার দিয়ে বাতাসের প্রবাহ তৈরি করে। এটি ট্রেনে লেগে থাকা পানি ঝরিয়ে ফেলে। ১৫টি কোচের জন্য পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট।

যে কারণে ৭/৮টি ট্রেনের বেশি ওয়াশ করা সম্ভব নয়

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ওয়াশ পিটে সিডিউল মেরামতের জন্য সকালে সাতটি, বিকেলে আটটি এবং রাতে ১০/১২টি ট্রেন আসে। ট্রেনগুলো লাইনে আনা-নেওয়া করতেই সময় পার হয়ে যায়। সময় মতো প্ল্যান্টে নিতে পারলে ২৪ ঘণ্টায় আরও বেশি ট্রেন ওয়াশ করা যেতে। প্ল্যান্টে ট্রেনের আউটসাইড পরিষ্কারের পর নেওয়া হয় অন্য লাইনে। সেখানে চারটি কাজ ম্যানুয়ালি শেষ করতে হয়।

অন্য লাইনে নিতে সময় লাগার কারণও ব্যাখ্যা করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, ওয়াশ পিটে ট্রেন আনতে যে গেট ব্যবহার করা হয়, ওই গেট দিয়ে আরও তিনটি লাইনে ট্রেন আনা-নেওয়ার কাজ চলে। যেহেতু জায়গা কম, গেট আর প্রসার করা সম্ভব নয়; এ কারণে অনেক সময় একটি ট্রেনের মুভমেন্ট করাতে অনেক সময় লেগে যায়।

ওয়াশ পিটে কর্মরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওয়াশিং প্ল্যান্টটি যদি বর্তমান স্থান থেকে আরও দক্ষিণে স্থাপন করা যেত তাহলে এটি আরও কার্যকর হতো। পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়ায় পরিষ্কারের পর রক্ষণাবেক্ষণের বাকি কাজগুলো দ্রুত শেষ করে ট্রেনগুলো সরাসরি ছেড়ে দেওয়া যেত। অটোমেটিক প্ল্যান্টে একটি ট্রেন ওয়াশ করতে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট সময় লাগে। বাকি কাজগুলো করতে ৪০-৫০ মিনিট সময় দিতে হয়।

অটোমেটিক ট্রেন ওয়াশিং প্ল্যান্টটি কতটুকু সহায়ক হয়েছে— জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াশ পিটের ইনচার্জ মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ প্ল্যান্টে একটি ট্রেন পরিষ্কার করতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ মিনিট। ম্যানুয়ালি একটি ট্রেন পরিষ্কার করতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। ওয়াশিং প্ল্যান্ট তো অবশ্যই সময়সাশ্রয়ী, কাজেও সহায়ক। মূলত, পরবর্তী যাত্রীসেবা নিশ্চিতের জন্য ওয়াশ পিট থেকে ট্রেনটি পুরোদমে প্রস্তুত হয়। সেখান থেকে বের হওয়া ট্রেনে আপনি কোনো ময়লা পাবেন না।

কোটি টাকা খরচ করেও যথাযথ সেবা মিলছে না। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন— জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ওয়াশিং প্ল্যান্ট বানিয়েছে রেলওয়ে বিভাগ। আমি বলব, রেলওয়ের আরও জটিল সমস্যা ছিল। সেগুলো প্রাধিকার দিয়ে আগে করা উচিত ছিল।

‘ওয়াশিং প্ল্যান্ট তৈরি একটি অপরিকল্পিত প্রকল্প। এটি পরেও করা যেত। রেলের ট্র্যাকগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা। তিন হাজার কিলোমিটারের যে রেল নেটওয়ার্ক, এর মধ্যে অনেক পয়েন্টে ট্রেনগুলো ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার গতিতেও চলতে পারে না। এসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। উল্টো সেখানে অত্যাধুনিক স্টেশন নির্মাণ, অত্যাধুনিক ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপন— এগুলো বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়!’

আমরা আগেও দেখেছি, রেলের অনেক প্রকল্প ফিজিবিলিটি স্টাডি না করে হুটহাট গ্রহণ করা হয়। ফলে প্রকল্পগুলো থেকে যে সুবিধা পাওয়ার কথা, সেগুলো পাওয়া যায় না। এর আগে এমন অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক অত্যাধুনিক স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে ট্রেন থামবে না। আগেও ম্যানুয়ালি ট্রেনগুলো ধোয়ামোছার কাজ হতো, এখনও হয়। আমার কাছে মনে হয়, ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপন টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়— বলেন এ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *