হাতবদলে প্রায় দেড় গুণ দাম বৃদ্ধি, ডিমের লাভ খাচ্ছে কারা?
মাছ-মাংসের বিকল্প সহজলভ্য আমিষ— ডিম, গরিবের শেষ ভরসার খাদ্যটিও এখন হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ডিমের বাজারেও এখন একটি দুষ্টচক্র কাজ করছে। তারাই বিভিন্ন সময় বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে, এতে উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত হাতবদলে প্রায় দেড় গুণ দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে ডিমের দাম।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত দুদিন ধরে ডিমের দাম অনেক বাড়তি। হালি ৬০ আর ডজন ঠেকেছে ১৮০ টাকায়। সেই হিসেবে ১০০ ডিমের দাম দাঁড়ায় ১৫০০ টাকা।
খামারিরা বলছেন, বর্তমানে ১০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা ৮০ পয়সার মধ্যেই উৎপাদন পর্যায়ে ডিম বিক্রি করছেন তারা। এতে ১০০ ডিমের দাম পড়ছে ১০৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১০৮০ টাকা।
খোঁজ নিয়েও জানা গেছে, পাইকারি পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৮০ পয়সা। সেই হিসেবে ১০০ ডিমের পাইকারি দাম ১০৮০ টাকা।
অথচ ভোক্তা পর্যায়ের খুচরা দোকানগুলোতে প্রতিটি ডিম ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন দোকানে ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। এতে ডজনে ডিমের খরচ পড়ছে ১৬৫ থেকে ১৮০ টাকা।
এদিকে ডিম উৎপাদন পর্যায়ের খামারিরা জানিয়েছেন, ডিমের দাম সব সময় ওঠানামা করে। তবে সেটা খুব বেশি না।
জামালপুরের সরিষাবাড়ি এলাকার ডিমের খামারি আরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রোববার ১০ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডিম পাইকাররা কিনে নিয়ে গেছেন। গতকাল বিক্রি করেছি ১০ টাকা ৩০ পয়সা এবং তার আগের দিন বিক্রি করেছি ১০ টাকা ৮০ পয়সা।’
তিনি বলেন, ‘ডিমের দাম প্রায় উঠানামা করে। তবে খাদ্যের দাম বাড়তি এবং এই মুহূর্তে ডিম উৎপাদনকারী মুরগি ও বাচ্চার সঙ্কট রয়েছে। তাই ডিমের দাম একটু বেশি। আগে ৮ টাকা থেকে সাড়ে ৮টা পিস দামেও ডিম বিক্রি করেছি। নিয়মিত ডিম পড়ার জন্য একটি মুরগিকে প্রস্তুত করতে ১৮০ দিন (৬ মাস) সময় লাগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ফার্ম থেকে যারা ১০ টাকা ৩০ পয়সায় ডিম কিনে নেন তাদের পরিবহন খরচ ১০০ ডিমে ২০ টাকা ও ডেমারেজ ১০ টাকা ধরতে হয়। অর্থাৎ খামার থেকে ডিম ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতি ডিমের দাম হয় ১০ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত।’
পাইকারদের দাবি, তারাও সীমিত লাভে বাজারে ডিম ছাড়েন। খুচরা বিক্রেতারা কি দামে ডিম বিক্রি করেন, সেটা তারা বলতে পারবেন না।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রোববার পাইকারিতে ১০০ ডিম ১০৮০ টাকা রেটে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ডিমের দাম পড়েছে ১০ টাকা ৮০ পয়সা।’
তাহলে খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিম ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি পাইকারি রেটে ডিম বিক্রি করি। খুচরায় কে কত টাকায় ডিম বিক্রি করছে সেটা আমি বলতে পারবো না।’
ডিমের বাড়তি লাভ খাচ্ছে কারা?
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ধাপে ধাপে হাতবদলে বাড়ছে ডিমের দাম। অনেক খুচরা দোকানি সরাসরি আড়ত থেকে ডিম কেনেন না। তারা স্থানীয় একটি পাইকার চক্র থেকে ডিম কেনেন। ওই চক্রটি আড়ত থেকে ডিম কিনে স্থানীয় দোকানে সাপ্লাই দেয়। তারা নিজেদের পাইকার পরিচয় দিয়ে খুচরা দোকানে ডিম প্রতি ১১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত দরে সাপ্লাই দিচ্ছেন। খুচরা বিক্রেতারা যা ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা হিসেবে ১৬৫ টাকা ডজনে ডিম বিক্রি করছেন। স্থানীয় পাইকার পরিচয় দেওয়া ডিম সাপ্লাইকারীদের কারসাজি ও খুচরায় বেশি লাভের আশা বাড়াচ্ছে ডিমের দাম। কখনো কখনো মূল আড়তেও দাম নিয়ে সিন্ডিকেট হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। সিন্ডিকেট চক্র তখন নিজেদের আড়াল করতে ক্যাশ মেমু ছাড়া ডিম কিনতে বাধ্য করেন।
মগবাজারের চারুলতা বাজার এলাকায় পাইকারি বলে ডিম বিক্রি করছিলেন শামসুদ্দিন। তার দোকান ঘুরে জানা গেছে, বাদামি রঙের ডিম ১৬০ টাকা ডজনে পাইকারি বিক্রি করছেন তিনি।
বাজারের ওই গলির কয়েকটি দোকান পরেই একটি মুদির দোকানে ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা ডজন দরে। আর আবাসিক এলাকার গলির ভেতরে দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা ডজনে।
রোববার সকালে মোহাম্মদপুরে তাজমহল রোড এলাকার একটি দোকান থেকে ১৮০ টাকা ডজন দরে ডিম কিনেছেন আফসারা আশরাফ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঈদের আগেও এই ডিমের দাম ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা ডজন দরে কিনেছি। আজ কিনতে গিয়ে দেখলাম ডজন ১৮০ টাকা হয়ে গেছে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই ডিমের দাম বেড়ে গেছে।’
মগবাজার এলাকায় ১৭০ টাকা ডজন দরে ডিম কিনেছেন জাহিদ হাসান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঈদের আগেও এই ডিমের দাম অনেক কম ছিল। ঈদের পর এসে এখন ডিম কিনতে গিয়ে দেখলাম ১৭০ টাকা ডজন। হঠাৎ ডিমের দাম কেন বাড়তি এ বিষয়ে দোকানদাররা কিছু বলতে পারছেন না।’
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান এস এম নাজির হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যারা ডিমের ব্যবসার এই কারবারির সঙ্গে যুক্ত, অতীতে তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। এ জন্য যারা এসব করেন, তারা বারবারই এই ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন। আর আমরা যে মনিটরিং বারবার করতে বলেছি, সেটিও করা হচ্ছে না। ফলে এরা বেপরোয়া হয়ে গেছে।’
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমিও ১৮০ টাকা ডজন দরেই ডিম কিনেছি। গতবার যখন ডিমের দাম ১৫০ টাকা হয়েছিল তখন এফোর্ট দিয়েছি; তারপরে আমি রিপোর্ট দিয়েছি কি কি করতে হবে। মামলা পর্যন্ত করেছি। এখন আমি এই বিষয়ে টায়ার্ড। আমার আর কিছু বলার নেই। আপনি এই বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে জিজ্ঞেস করেন।’
অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ঢাকা পোস্টে’ প্রকাশিত আরও ছবিসহ মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে…