লাইসেন্স প্রিন্টের কার্ড নেই বিআরটিএতে, বিপাকে আবেদনকারীরা
আব্দুল কাশেম (ছদ্মনাম) একটি অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই ড্রাইভিং লাইসেন্সের নির্ধারিত ফিও পরিশোধ করেছেন। কিন্তু এই ঘটনার প্রায় ৬ মাস পার হতে চললেও এখন পর্যন্ত তার ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ডটি প্রিন্ট করতে পারেনি বিআরটিএ।
আব্দুল কাশেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, লাইসেন্সের জন্য লিখিত, মৌখিক, ব্যবহারিক পরীক্ষা ও টাকা জমা দিয়েছি গত বছরের জুলাই মাসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার লাইসেন্স কার্ডটি প্রিন্ট হয়নি। এ বিষয়ে কারও কাছ থেকে কোনো তথ্যও পাচ্ছি না। বিআরটিএতে গেলে তারা জানায়, হয়ে যাবে। কিন্তু কবে হবে, সেটি কেউ আর জানায় না। দেখতে দেখতে ৬ মাস হয়ে গেল। অথচ জানতাম এক মাসের মধ্যে বিআরটিএ পুরো ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড সরবরাহ করে।
সৌদি আরব যাওয়ার জন্য সব প্রয়োজনীয় কাগজ প্রস্তুত আছে রাব্বী হোসাইন আকাশের। শুধুমাত্র ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড হাতে পেলেই জীবিকার উদ্দেশ্যে সৌদিতে পাড়ি জমাবেন তিনি। ভিসার শর্তানুযায়ী তাকে অবশ্যই ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে সেদেশে যেতে হবে।
সে অনুযায়ী আরও ৫ মাস আগে থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কাজ শুরু করেন তিনি। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নির্ধারিত ফিও জমা দেন। কিন্তু দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও তার কার্ডটিও প্রিন্ট করতে পারেনি বিআরটিএ।
এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত কার্ডটি পেতে চেয়ারম্যানের সুপারিশ পাওয়ার জন্য বিআরটিএর সদর কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানে রাব্বী হোসাইন আকাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমি যেতে না পারলে ভিসা বাতিল হয়ে যাবে। দ্রুত যাওয়ার জন্য আমার মালিক ও অ্যাম্বেসি থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। আমার মেডিকেলের মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি এই ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সেখানে যেতে না পারলে আমার অনেক লস হবে।
শুধু আব্দুল কাশেম বা রাব্বী হোসাইন আকাশই না, এমন সমস্যা নিয়ে নিয়মিতই ভুক্তভোগীরা বিআরটিএর সদর কার্যালয়সহ সার্কেল অফিসগুলোতে ভিড় করছে। এমন আরও কয়েকটি অভিযোগ ঢাকা পোস্টের হাতে আছে। নির্ধারিত সময়ে বিআরটিএ কার্ড সরবরাহ করতে না পারায় সাধারণ আবেদনকারীর পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে বিদেশগামী ড্রাইভিং লাইসেন্স আবেদনকারীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাপানোর কার্ড সংকট হওয়াতে এমন জটিলতায় পড়েছে বিআরটিএ। গত বছরের মাঝামাঝিতেও এমন ভয়াবহ কার্ড সংকটে পড়েছিল সরকারের এই সংস্থাটি।
যে কারণে কার্ড সংকট
বিআরটিএর পক্ষে বাংলাদেশে ডুয়েল ইন্টারফেস পলিকার্বনেট স্মার্ট কার্ড তৈরির জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে সরকারের এই সংস্থাটি। এই চুক্তি অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ২৯ জুলাই। ওই দিন থেকে ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে। এই ৫ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ৪০ লাখ কার্ড প্রিন্ট করে সরবরাহ করার কথা আছে।
চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি কার্ডসহ প্রিন্ট বাবদ ৩০০ টাকা ১৫ পয়সা খরচ ধরা হয়েছে। পুরো চুক্তির মূল্য ধরা হয়েছে ১২০ কোটি ৬ লাখ টাকা।
বিআরটিএর একটি দায়িত্বশীল সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানান, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটির কাছে এখন কোনো কার্ড নেই। প্রতিষ্ঠানটি আমাদের জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে কার্ড খালাস করতে পারছে না। চুক্তির সময় ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, এখন পৌঁছেছে ১২৫ টাকায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএ’র কার্ড সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি বলেন, ২ সপ্তাহ আগে ২৫ হাজার কার্ড ভারত থেকে দেশে এসেছে। কিন্তু তারা (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) এখনও কার্ড খালাস করতে পারেনি। চুক্তি অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানটি কখনোই ঠিকভাবে কার্ড সরবরাহ করতে পারেনি আমাদের। তারপরও সব দোষ এখন আমাদের ঘাড়ে।
আরও জানা যায়, চুক্তির দিন থেকে পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ২৪ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছরে কার্ড সরবরাহ করেছে মাত্র ১৬ লাখের মতো।
মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক বড় সংখ্যার কোনো লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) দিচ্ছে না। ফলে ভারতে কার্ড থাকলেও আনা যাচ্ছে না।
এই মুহূর্তে ঠিক কত কার্ড প্রয়োজন?
দায়িত্বশীল সূত্রটি জানায়, বাংলাদেশে বর্তমান প্রতি বছর অন্তত ৭ লাখ কার্ড প্রয়োজন। এখন ঘটতি আছে আরও ৮ লাখ। এর সঙ্গে চুক্তি পরিবর্তনের সময় প্রায় ১২ লাখ আবেদন জমা পড়েছিল। ফলে এতো বিপুল সংখ্যক কার্ডের চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ ঠিক রাখতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
আরেকটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানায়, গত বছর যখন কার্ড সংকট হয় তখন প্রায় ৬ লাখ কার্ডের ঘাটতি ছিল। সে সময় ৫ লাখ কার্ড দেশে আনা হয়। আমদানি অনুমতির মাধ্যমে আনা কার্ডগুলো পুরোনোদের দেওয়া হয়। সেই স্টকও শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে আর আবেদনকারীদের এখন কার্ড দেওয়া যাচ্ছে না। তবে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের সুপারিশে জরুরি প্রয়োজনের কাউকে কাউকে কার্ড দেওয়া হচ্ছে।
এসব বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, কার্ড নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। এটা বৈশ্বিক সমস্যার একটি অংশ। তবে দেশে গাড়ি চালানোর জন্য এখন বিআরটিএ থেকে ‘ই-লাইসেন্স’ দেওয়া হচ্ছে। কার্ডের এই সমস্যা দ্রুতই কেটে যাবে। বিমানবন্দরে কিছু কার্ড এসেছে। দুই একদিনের মধ্যেই এগুলো ছাড় পাবে।
বিআরটিএর পক্ষে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক আশরাফ বিন মুস্তফা বলেন, আগে আমাদের এলসি চুক্তি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। সেটি কাটিয়ে গতবছর দেশে ৫ লাখ কার্ড আনা হয়েছিল। এই কার্ডগুলো তখন এসেছিল আমদানি অনুমতির মাধ্যমে। এখন এলসি নিয়ে ঝামেলা নেই। তবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংক তাদের বড় সংখ্যার এলসি দিতে চাইছে না।
তিনি আরও বলেন, ছোট এলসির কারণে এখন ছোট সংখ্যায় কার্ড আনা হচ্ছে। তবে সেটাতে খুশি নয় বিআরটিএ। এখন ৫০ হাজার করে কার্ড আনা যাচ্ছে। শুধুমাত্র শেষবার ২৫ হাজার কার্ড এসেছে। কিন্তু তারা সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য (সাফটা) চুক্তি করেছে। তবে সেই চুক্তিতে নাম ভুল থাকায় বিমানবন্দরের শুল্ক কর্তৃপক্ষ কার্ড ছাড় দিচ্ছে না। ভারতীয় কোম্পানিতে আমাদের ৫ লাখ কার্ড পড়ে থাকা সত্ত্বেও সে কার্ড বাংলাদেশে আনা যাচ্ছে না।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত আরও ছবিসহ মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে…